মৃত ব্যক্তির জন্য আমাদের করণীয় : পাতা -০৫
পাতা -০৫
হজ্জের ইহরাম পরা অবস্থায় মৃত হাজীকে তার ঐ ইহরামের কাপড় দিয়েই কাফন দেয়া
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “একদা জনৈক ব্যক্তি হজ্জের বেলায় আরাফাতে অবস্থানের সময় হঠাৎ সে বাহন থেকে পড়ে গেলে সওয়ারী তার ঘাড় মুচড়ে দেয় অথবা আপনা-আপনানিই তার ঘাড় মুচড়ে যায়। তাতে তার মৃত্যু হয়। তখন নবী (ছ:) বললেন: কুলপাতা সিক্ত পানি দিয়ে তাকে গোসল দাও এবং (তার পরিধানের বস্ত্র) দুটি দিয়েই তাকে কাফন দাও। কিন্তু তার (গোসলে অথবা কাফনে) কোন প্রকার সুগন্ধি লাগাবে না এবং কাফনে তার মাথাও আবৃত করবে না। কেননা সে কিয়ামতের দিন ‘তালবিয়া’ পাঠ করা অবস্থায় উঠবে।” (বুখারী, হা: নং ১১৮৩)
‘তালবিয়া’ অর্থাৎ হজ্জের জন্য হাজীগণ ইহরাম বেঁধে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা ……” বলে যে সুনির্দিষ্ট দু’আ পাঠ করে তা-ই।
মৃত ব্যক্তির পরিবার-পরিজনদের জন্য তার নিকটাত্মীয় গন খাবারের ব্যবস্থা করা
হযরত আসমা বিনতে ‘উমাইস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জা’ফর (রাঃ) শহীদ হওয়ার সংবাদ পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ (ছ:) নিজের পরিবারের নিকট এসে বললেন, জাফরের পরিবার তাদের মধ্যে মৃত লোকের কারণে ব্যস্ত। অতএব তোমরা তাদের জন্য খাবার তৈরি করো। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন এটা সুন্নাত হিসেবে পরিগণিত হয়। তবে পরে তা আলোচনার বিষয়ে পরিণত হলে বর্জন করা হয়। (ইবনে মাজাহ হা: নং ১৬১১)
মৃত ব্যক্তির কাফন-দাফনে বিলম্ব না করা
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ছ:) বলেছেন:
أسْرِعُوا بِالْجَنَازَةِ فَإِنْ تَكُ صَالِحَةً فَخَيْرٌ تُقَدِّمُونَهَا إِلَيْهَا وَإِنْ تَكُ سوى ذلِكَ فَشَرٌ تَضَعُونَهُ عَنْ رِقَابِكُمْ
তোমরা জানাযাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে চলো। কারণ যদি সে পূণ্যবান হয় তাহলে সে উত্তম ব্যক্তি। তোমরা তাকে কল্যাণের দিকে এগিয়ে নিয়ে দিলে। আর যদি সে তা না হয়ে অন্য কিছু হয়ে থাকে, তাহলে সে একটি ‘আপদ’ তাড়াতাড়ি তাকে তোমাদের কাঁধ থেকে নামিয়ে দাও। (বুখারী হা: নং ১২২৯, মুসলিম হা: নং ২৭৫৯)
বুখারীর অপর বর্ণনা সূত্রে হযরত আবু সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ছঃ) বলেছেন: “মৃত ব্যক্তিকে খাটিয়ায় রেখে যখন লোকেরা কাঁধে উঠিয়ে নেয়, তখন সে যদি পূণ্যবান হয় তাহলে বলে, আমাকে তাড়াতাড়ি সামনে নিয়ে চলো। আর যদি পূণ্যবান না হয়, তখন সে আপন পরিজনকে বলে, হায়। ‘তোমরা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’ মানুষ ছাড়া প্রত্যেকেই তার সে আহাজারি শুনতে পায়, কিন্তু মানুষ যদি তার এই আহাজারি শুনতো তাহলে বেহুঁশ হয়ে পড়তো।” (হা: নং ১২৩০)
মৃত ব্যক্তির জানাযার নামায পড়া
হযরত মারছাদ ইবনে আবদুল্লাহ আল ইয়াযানী (রাহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মালেক ইবনে হুবাইরা (রাঃ) যখন জানাযার নামায আদায় করতেন তখন লোকজনের উপস্থিতি কম হলে তাদেরকে তিনি তিন সারিতে ভাগ করতেন। তারপর তিনি বলতেন রাসূলুল্লাহ (দ্বঃ) বলেছেন:
مَنْ صَلَّى عَلَيْهِ ثَلاثَةٌ صُفُوفَ فَقَدْ أَوْجَبَ
যে ব্যক্তির জানাযার নামায তিন কাতার লোক আদায় করেছে তার জন্য
অবধারিত হয়েছে। (তিরমিজী হা: নং ৯৬৭) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর আযাদকৃত গোলাম কুরাইব (রাঃ) থেকে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণিত। ‘কুদাইদ’ অথবা ‘উছফান’ নামক স্থানে তার একটি পুত্র সন্তান মারা গেলে তিনি আমাকে বললেন, হে কুরাইব! দেখ কিছু লোক উপস্থিত হয়েছে কিনা? আমি বের হয়ে দেখলাম কিছু লোক উপস্থিত হয়েছে। এ কথা আমি তাকে জানালে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি বল তাদের সংখ্যা কি চল্লিশ হবে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে কফিন বের করে নাও। আমি রাসূলুল্লাহ (দ্বঃ)-কে বলতে শুনেছি: কোন মুসলমান ব্যক্তি মারা গেলে, তার জানাযায় যদি এমন চল্লিশ জন মানুষ দাঁড়ায় যারা আল্লার সাথে কোন কিছুকে শরীক করে না, তাহলে মহান আল্লাহ তাঁর অনুকূলে তাদের প্রার্থনা কবুল করেন।” (মুসলিম হা: নং ২০৭২)
জানাযা নামায পড়ার সঠিক নিয়ম:
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
أَنَّ النَّبِيُّ ﷺ قَرَأَ عَلَى الْجَنَازَة بفاتحة الكتاب
নবী (ছ:) জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন। (তিরমিজী-হাঃ নং- ৯৬৫, ইবনে মাজাহ- হা: নং- ১৪৯৫)
ইবনে মাজাহর অপর বর্ণনা সূত্রে হযরত উম্মু শারীক আল-আনছারিয়া (রাঃ) বলেন:
أَمَرَنَا رَسُولُ اللَّهِ ﷺ أَنْ نَّقْرَأَ عَلَى الجَنازَة بفاتحة الكتاب
রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) আমাদেরকে জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (হা: নং-১৪৯৬)
বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহর বর্ণনা সূত্রে হযরত উবাদাতা ইবনে সামেত (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ قَالَ لأَصَلوةَ لِمَنْ لا يَقْرَأُ بِفاتحة الكتاب
রাসূলুল্লাহ্ (ছুঃ) বলেছেন: যে লোক (নামাযে) সূরা ফাতিহা পড়ে না তার কোন নামাযই হয় না। (হা: নং- বুখারী- ৭১২, মুসলিম- ৭৭১, নাসায়ী- ৯১১, ইবনে মাজাহ্- ৮৩৭)
বুখারীর বর্ণনা সূত্রে হযরত তালহা ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে আওফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন:
صلَّيْتُ خَلَفَ ابْنِ عَبَّاسٍ عَلَى جَنَازَةِ فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَقَالَ لِيَعْلَمُوا أَنَّهَا سُنَّةٌ
আমি ইবনে আব্বাসের পেছনে জানাযার নামায আদায় করেছি। তিনি (সূরা) ফাতিহা পাঠ করে জানাযার নামায আদায় করলেন এবং পরে বললেন, (আমি এরূপ এজন্যই করলাম) যাতে লোকেরা এটাই সুন্নাত (অর্থাৎ নিয়ম) বলে জানতে পারে। (হা: নং- ১২৪৭)
নাসায়ী ও তিরমিজী বর্ণনা সূত্রে হযরত তালহা ইবনে আবদুল্লাহ্ (রাহঃ) বলেন: “আমি ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর পেছনে জানাযার নামায পড়লাম। আমি তাঁকে (সূরা) ফাতিহা পাঠ করতে শুনলাম। তিনি নামায থেকে ফিরলেই আমি তাঁর হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম। আপনি কি জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এটাই তো নিয়ম এবং সঠিক। (হা: নং নাসায়ী- ১৯৯০, তিরমিজী- ১৬৬)
হযরত আবু আমামা ইবনে সাহাল (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তাঁকে রাসূল (দ্বঃ)- এর একজন ছাহাবী জানিয়ে দিয়েছেন:
أن السُّنَّةَ فِي الصَّلوةِ عَلَى الْجَنَازَةِ أَنْ يُكَبِّرَ الإِمَامُ ثُمَّ يَقْرَأ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ بَعْدَ التَّكْبِيرَةِ الأُولَى سِرًّا فِي نَفْسِهِ ثُمَّ يُصَلَّى على النبي ﷺ وَيَخْلُصُ الدُّعَاءَ للجنازة في التكبيرات ولا يَقْراً فِي شَيْ مِنْهُنَّ ثُمَّ يُسَلِّمُ سِرًّا فِي نَفْسِهِ
জানাযার নামাযের নিয়ম হলো: ইমাম তাকবীর বলবে অতঃপর এ প্রথম তাকবীরের পর নিঃশব্দে সূরা: ফাতিহা পড়বে। এরপর (দ্বিতীয় তাকবীর বলার পর) নবী (ছুঃ)-এর উপর দুরূদ পড়বে, (এর পরবর্তী তাকবীর বলার পর) মৃতের জন্য খালেছুভাবে দু’আ পড়বে এবং তার (তারপরবর্তী তাকবীরের পর) পর অন্য কিছু পড়বে না বরং নিঃশব্দে [এক দিকে (ডানে)] সালাম ফিরাবে। (নাসায়ী, মুসনাদে শাফি’য়ী)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
أنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى عَلَى جَنَازَةٍ فَكَبِّرَ عَلَيْهَا أَرْبَعًا وَسَلَّمَ تسليمة واحدة
রাসূলুল্লাহ (দ্বঃ) জানাযার নামায চার তাকবীরে আদায় করলেন এবং শুধু এক দিকে সালাম ফিরালেন। (দ্যরাকৃতনী- ১৯১, হাকেম, ৩৬০)
এ ছাড়া হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে ছুহীহ সূত্রে সাব্যস্ত হয়েছে যে, “হযরত আলী ইবনে আবী তালেব, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস, জাবের ইবনে আবদুল্লাহ, আবদুল্লাহ ইবনে আবী আউফা (রাঃ) তাঁরা সবাই জানাযার নামযে একদিকে এক সালামই ফিরাতেন।” (আহকামুল জানাইয- আলবানী)
উপরে বর্ণিত হাদীছ অনুযায়ী জানাযার নামায পড়ার সঠিক নিয়ম হলো- মনে মনে নিয়্যত করে জানাযার নামাযের জন্য দাঁড়ানোর পর প্রথম তাকবীর বলে (ছানা না পড়ে) ‘সূরা ফাতিহা’ পড়া, তারপর দ্বিতীয় তাকবীর বলে দুরূদ (দুরূদে ইবরাহীমী) পড়া, তারপর তৃতীয় তাকবীর বলে (জানাযার নামাযে পড়ার) দু’আ পড়া, অতঃপর চতুর্থ তাকবীর বলে শুধু ডান দিকে সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করা।
আগের পাতা: ০৪ | পরবর্তী পাতা: ০৬